ফুলবাড়িয়া প্রতিনিধিঃ ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার নাওগাঁও ইউনিয়নের নাওগাঁও পশ্চিম পাড়া গ্রামে শালিসে উপস্থিত না হওয়ায় বাবা-ছেলেকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা দু-মাস পেরিয়ে গেলেও মামলার মূল আসামীরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।এদিকে হত্যার মাস্টারমাইন্ডদের গ্রেপ্তারে পুলিশের গড়িমিসিতে মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত নিহতের পরিবার।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলায় পুলিশ কয়েক ধাপে দুই ইউপি সদস্যসহ এজহারভুক্ত ৭ জন আসামীকে গ্রেপ্তার করলেও জোড়া খুনের ঘটনায় সরাসরি নেতৃত্বদানকারি প্রভাবশালী আসামী কাউকেই আটক করতে পারেনি। এনিয়ে প্রশ্ন উঠছে প্রভাবশালী মূল আসামীদেরকে বিশেষ কোন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কিনা?
পুলিশ গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দুই মেম্বারসহ ৩ আসামীকে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠালে বিজ্ঞ আদালত আসামীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামীদের জিজ্ঞাসা শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো.লিটনমিয়া গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি এ নির্মম হত্যাকান্ডটি একটি পরিকল্পিত হত্যা বলেও তিনি জানান।
নিহত গফুরের বড় ভাই আবুল কালাম জানান, আসামীরা প্রভাবশালী হওয়ায় টাকার বিনিময়ে মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ঘটনার দুই মাস অতিবাহিত হলেও এ মামলার প্রধান আসামী প্রভাবশালী মোতালেব(৫৫),ও তার ছেলে সোহেল (৩৫) দুই নাম্বার আসামীসহ ৩ নাম্বার আসামী নাওগাঁও ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রভাবশালী হাবিবুর রহমানকে পুলিশ আটক করতে না পারায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আসামি ধরতে পুলিশের কালক্ষেপণের সুযোগে হত্যার সাথে জড়িত আসামীরা উচ্চ আদালত থেকে কয়েক দফায় অন্তর্বর্তী জামিনে থাকার সুযোগ পেয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও এ মামলার তদন্তকারী গ্রামের বাড়ি ফুলবাড়িয়া উপজেলার সিমান্তবর্তী উপজেলার ঘাটাইলের গাড়ো বাজার এলাকায় হওয়ায় নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মামলার এজহার নামীয় হত্যাকান্ডের মূলহোতা বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমানের ৩ ছেলেসহ৯ আসামী দুই দফায় উচ্চ আদালত থেকে আগাম ৮ সপ্তাহের জামিনে রয়েছেন।এছাড়াও আরেক দফায় হাবিবুর ও প্রধান আসামী মোতালেবের ছেলে সাকিল উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের জামিন নিয়েছেন বলেও পুলিশ জানান। তবে মামলার প্রধান আসামী মোতালেব এখনও ধরাছোয়ার বাইরে ।
ঘটনার অনুসন্ধানে নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সুত্রে উঠে এসেছে রোমহর্ষক চিত্র। হত্যাকারীরা তাদের পারিবারিক দ¦ন্দকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করে দুই ইউনিয়নের জনসাধারণকে ফুসিয়ে তুলে বসতবাড়িতে ডুকে দেশিয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে নির্মম এ হত্যা কান্ডটি ঘটিয়েছেন।
প্রভাবশালী আসামীদের আঘাতে গফুর ও তার ছেলে মেহেদী মৃত্যুশয্যায় উপনীত হলেও তার স্বজনদের কাউকেই সেখানে ডুকতে দেয়া হয়নি। বাবা ছেলে মৃত্যুর আগে বারবার পানি চাইলেও উল্টো স্থানীয় গ্রাম পুলিশদের দিয়ে বাড়ির গেইটে বসিয়ে গেইটটি আটকে রাখে, যাতে করে তাদেরকে কেউ পানি না দেয় এমন বর্নণা দেন নিহতের স্বজেনরা।
শালিসে উপস্থিত থাকা এক গ্রাম পুলিশ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে জানান, এটি তাদের নিজেদের পারিবারিক কলহের ঘটনা ছিল। মাদক ও চুরির অপবাদ দিয়ে শালিস বসিয়ে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা বুজতে পারলে ওই শালিসেই উপস্থিত হতাম না।
অভিযোগ উঠেছে, মামলা থেকে রেহাই পেতে আসামীরা টাকা দিয়ে পার পাবার চেষ্টা করছেন। আসামিরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ায় জোড়া খুনের মতো ন্যাক্কার জনক ঘটনার দুঃসাহস দেখিয়েছে। আসামীদের ভয়ে স্থানীয়রা জোড়া খুনের ঘটনায় প্রকাশ্যে কোন কথা বলতেও রাজি হচ্ছে না।
নাওগাঁও ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী বলেন,শালিসটি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে না হয়ে ইউনিয়ন পরিষদে হলে হত্যাকান্ডের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটতো না। ইউনিয়ন পরিষদকে না জানিয়ে প্রভাবশালীদের কথায় দুই মেম্বার গ্রাম পুলিশ দিয়ে নোটিশ করিয়ে নাওগাঁও ও প¦ার্শবর্তী রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের লোকজনকে শালিসে উপস্থিত করিয়েছেন যা মোটেও ঠিক হয়নি।ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরিষদের অনুমতি ছাড়াই গ্রাম পুলিশ নোটিশ জারি করায় তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা ? এ প্রশ্নে তিনি প্রতিবেদককে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ার কথা জানান।
গফুরের বয়োবৃদ্ধ পিতা হিকমত আলী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, আমার ছেলে ও নাতিনকে যেভাবে মারছে কুকুর শেয়ালকেও এভাবে কেউ মারে না।ছেলে ও নাতি হত্যার জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি আসামীদের ফাঁসির দাবি জানান তিনি।
মামলার বাদী শিল্পী আক্তার বলেন, আমার স্বামী ও সৎ ছেলে হত্যার মূল আসামীদের গ্রেপ্তারে বারবার পুলিশকে তাগাদা দিচ্ছি, তারা আমাকে শুধু ধৈর্য ধরতে বলে আর বলে যে খুব শীঘ্রই আমরা আসামী ধরবো। হত্যার প্রধান আসামীকে গ্রেপ্তারের কথা বললেও তারা তাকে গ্রেপ্তার করেননি। এ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত না হলে তিনি মামলা অন্যত্র স্থানান্তর করবেন বলেও জানান।
জোড়া হত্যা মামলার মূল আসামী গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে ফুলবাড়িয়া থানার ওসি মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান বলেন, আসামীরা পালিয়ে থেকে উচ্চ আদালত হতে অন্তর্বর্তী জামিনে এসেছে। পুলিশ সুপার মহোদয়ের নির্দেশে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য গত (১৩ এপ্রিল) রোববার দুপুরে নাওগাঁও পশ্চিমপাড়া গ্রামে শালিসকে কেন্দ্র করে আব্দুল গফুর ও তার ১৫ বছর বয়সি কিশোর ছেলে মেহেদী হাসানকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ মামলায় ২২ জনের নাম উল্লেখসহ আরও অজ্ঞাতনামা ৬০ জনকে আসামী করে হত্যা মামলা করেন শিল্পি আক্তার। তিনি নিহত গফুরের দ্বিতীয় স্ত্রী।
0 Comments